শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু


scrolls
সংকলনে : আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব

পিতার সাথে বিরোধ 

শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীছের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীছের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন। একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনিالروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।

পেশাজীবী আলবানী 

শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল। তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীছে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।

দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী 

প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।

বইয়ের পোকা আলবানী 

তিনি হাদীছের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।

জহূরী জহর চেনে 

হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীছ নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক 

(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীছে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীছ শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بل هو خير من الأدب ‘রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।

নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন 

একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।

তিন মনীষীর মহামিলন 

শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীছ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন।

গাড়িচালক আলবানী 

শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।

খেলাধুলায় আলবানী 

শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীছ দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’

সৃজনশীল কারিগর 

শায়খ আলবানী ইলমে হাদীছে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র‌্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র‌্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীছের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।

প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব 

একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।

প্রচারবিমুখতা 

১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীছের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!

কারাজীবনে আলবানী 

শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
Courtesy: মাসিক আত- তাহরীক
                                                         See more........
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ
যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয় হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময় অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক, না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক, অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময় ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।
তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না। কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো, আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি? অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো জিনিস আছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয় করা।
আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন। কুরআন আমাদের বলে :
“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা হয়েছিল যে:“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-কামার; ৫৪ : ১০]নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্‌ যখন বললেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :
“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্‌ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ ” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ৩০]মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে। আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে। তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো সম্ভব।
উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা, বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্‌ বলেন :
“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনেঅবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ২৫৬]“আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকেই বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে না। অন্তরে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।
তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি? কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?
আবূ বাক্‌র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন, এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্‌তাহ্‌ নামে তারই এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্‌র অপবাদ আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্‌ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ্‌ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-নূর; ২৪:২২]এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্‌র (রা) বুঝতে পারলেন যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্‌র ক্ষমা চান। তাই তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে লাগলেন।মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন :
“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]‘আমি নিজেও  ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ — নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে, আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্‌র সাথে তুলনা করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা যদি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি, তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :
“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্‌ও তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম; অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]আল্লাহ্‌র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম, অতুলনীয়।
                                                                                See more>>>>

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

লেখক: আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান | সম্পাদক: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি, তার নিকট ক্ষমা চাই, আমাদের অন্তরের অনিষ্ট এবং মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ তাআলা যাকে হেদায়েত দেবেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করবেন সে কাউকে তার সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পাবে না।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক, তার কোন শরিক নেই। এবং কথারও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর দয়া ও অধিক পরিমাণ সালাম তার উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবাদের উপর বর্ষিত হউক।হে মুসলমানেরা!আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা একমাত্র তারই ইবাদত করে, এবং তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আল্লাহ তাআলা যা রিযক দিয়েছেন তার মধ্য থেকে হালাল ভক্ষণ করে, অপবিত্র এবং হারাম থেকে বেচেঁ থাকে, আল্লাহ তাআলা বলেন:الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ سورة الأعراف: 157."যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী, যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে।" [সূরা আল আরাফ ১৫৭ আয়াত ]হে আল্লাহর বান্দারা!প্রত্যেক মুসলমানের উপর হালাল উপার্জন করা ওয়াজিব যদিও তা কষ্টকর হয়। বাস্তবে হালাল উপার্জন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু দিন থেকে আমরা দুরে থাকার কারণে এবং বস্তুগত মাধ্যমের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়ে পড়ার কারণে এবং নীতিবোধ উঠে যাওয়ার কারণে কঠিন মনে হয়। মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসার কারণে অনেক মানুষ হারামের দিকে পতিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের হালাল চিনতে অসুবিধা হচ্ছে, তারা মনে করছে এখন হালাল হারিয়ে গেছে। হালাল খুজে পাওয়া সম্ভব নয়। হারামের দিকে রাস্তা ধরা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।  আর যিনি আমাদেরকে সত্য দিন এর উপর রেখে গেছেন তিনি বলেছেন:" إن الحلال بيِّن، وإن الحرام بيِّن، وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه، ألا وإن لكل ملكٍ حمى، ألا وإن حمى الله محارمه، ألا وإن في الجسد مضغة.. الحديث "1.নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট এদুটির মাঝখানে সন্দেহযুক্ত বিষয় আছে অনেক লোক তা জানে না। যে সন্দেহযুক্ত জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে তার দিন এবং সম্মানকে ত্রুটি মুক্ত রাখল। আর যে সন্দেহযুক্ত জিনিসের মধ্যে পতিত হল সে হারামের মধ্যে পতিত হল। ঐ রাখালের ন্যায় যে সংরক্ষিত এলাকার নিকট চারণ করে আশংকা আছে তার মধ্যে ঢুকে পড়ার। সাবধান! প্রত্যেক বাদশার একটি সংরক্ষিত এলাকা আছে, জেনে রাখ‍! আল্লাহ  তাআলার সংরক্ষিত এলাকা হল তার হারাম করা বিষয়, জেনে রাখ! শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড আছে। [ বুখারি, মুসলিম, আন নবাবি ৪০ হাদিস, হাদিস নং ৬ ]যে ব্যক্তি দিন রক্ষার ব্যাপারে যত্নবান তার নিকট যদি কোন বিষয় হারাম হালাল হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ হয় তবে না জানা থাকলে জ্ঞানীলোকদের থেকে জেনে নেবে যেমন আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ سورة النحل: 43."সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।" [ সূরা আন-নাহল ৪৩ আয়াত ]ঐ সকল লেন-দেন যা শরীয়ত ভিত্তিক নয় এবং তা স্পষ্ট তবে তা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার পর্যায়ে পড়ে যাকে আল্লাহ তাআলা তা হারাম এবং নিষিদ্ধ করেছেন। মানুষ আজকাল হারাম উপার্জনের ব্যাপারে অনেক বেশি উদাসীন হয়ে গেছে: শ্রমিক তার কাজ সঠিকভাবে করে না। আবার অনেক সময় মালিক পক্ষ কাজের পারিশ্রমিক দেয় না। দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার কর্ম সঠিকভাবে পালন করে না। ব্যবসায়ী তার দ্রব্যের মধ্যে ভেজাল দেয়। সুদী কারবারী সাহসী হয়ে উঠে। তারা মানুষের ক্ষতি করে এমন জিনিসের ব্যবসা করে এমনকি অনেক ব্যবসায়ের বস্তু মানুষের জীবন ধংস করে দেয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল সেই ব্যক্তি যে হেদায়েতের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে শয়তানের সাথে আপোস করল।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থাতো এই ছিল ঘরের কোনে একটি খেজুর তার বিছানায় পড়ে পেলেন সেটি উঠালেন খাওয়ার জন্য অত:পর আশঙ্কা করলেন এটি সাদকাহওতো হতে পারে, পরে ফেলে দিলেন। ইমাম বুখারি রহ: আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: " إني لأنقلب إلى أهلي فأجد التمرة ساقطة على فراشي فأرفعها لآكلها، ثم أخشى أن تكون صدقة فألقيها "،"আমি আমার পরিবারের নিকট গেলাম আমার বিছানায় খেজুর পড়ে থাকা অবস্থায় পেলাম আমি সেটি খাওয়ার জন্য উঠালাম অত:পর ভয় হল তাতো সাদাকাহ হতে পারে তাই ফেলে দিলাম।" [ মুসলিম ১৭৮০ ]  তার সাহাবীরাও হারাম থেকে এমন ভয়ে থাকতেন। দেখুন না আবু বকর সিদ্দিক রা. এর অবস্থা তার একটি কৃত দাস ছিল যে তার ট্যাক্স আদায় করত, আবু বকর রা. ট্যাক্সের পয়সায় তার সংসার চলত, সে একদিন তার জন্য একটা জিনিস আনল আবু বকর রা. তার থেকে খেলেন। কৃতদাসটি তাকে বলল এটা কি তা আপনি জানেন? তিনি প্রশ্ন করলেন এটা কি? সে বলল: আমি ইসলাম পূর্বযুগে এক ব্যক্তির রাশিফল গণনা করেছিলাম। আর এ রাশিফল গণনা করতে আমি তার সাথে ধোকাবাজী করতাম। তার সাথে আজ আমার সাক্ষাত হওয়ার পর সে আমাকে ঐ জিনিস দিয়েছিল। তার থেকেই আপনি খেয়েছেন, আবু বকর রা. মুখের ভিতর হাত দিলেন এবং পেটের ভিতর যা ছিল সব বমি করে দিলেন।(আবু বকর রা. এর ঘটনা ইমাম বুখারি রহ. মানাকেব অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।) কায়াব বিন আজরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রাসূল সা. আমাকে বললেন:: أعيذك بالله يا كعب بن عجرة من أمراء يكونون من بعدي فمن غشي أبوابهم فصدقهم في كذبهم وأعانهم على ظلمهم فليس مني ولست منه ولا يرد علي الحوض ومن غشي أبوابهم أو لم يغش فلم يصدقهم في كذبهم ولم يعنهم على ظلمهم فهو مني وأنا منه وسيرد علي الحوض يا كعب بن عجرة الصلاة برهان والصوم جنة حصينة والصدقة تطفئ الخطيئة كما يطفئ الماء النار يا كعب بن عجرة إنه لا يربو لحم نبت من سحت إلا كانت النار أولى به" رواه الترمذي وقال: هذا حديث حسن غريب وصححه الألباني 614"হে কাআব বিন আজরা! আমি আল্লাহ তাআলার নিকট তোমার জন্য ঐ সমস্ত শাসক থেকে আশ্রয় পার্থনা করছি যারা আমার পরে আসবে। যে ব্যক্তি তাদের দরবারে যাবে তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করবে। তাদের অত্যাচারে সাহায্য করবে সে আমার সাথে নয়। আমিও তার সাথে নই। সে হাউজে আসতে পারবে না। আর যে তাদের দরবারে গেল অথবা না গেল, তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করল না। তাদের অত্যাচারে সাহায্য করল না। সে আমার সাথে আমিও তার সাথে এবং সে হাউজের কাছে আমার সাথে সাক্ষাত করবে। হে কাআব ইবনে আজরা নামাজ হল দলিল-প্রমাণ। সিয়াম হল শক্ত ঢাল। দান সদকা গোনাহকে তেমনই মিটিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে মিটিয়ে দেয়। হে কাআব ইবনে আজরা! ঐ মাংশ বৃদ্ধি পায় না যা হারাম দ্বারা তৈরী হয়। বরং জাহান্নাম এর থেকে উত্তম।" [ তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে বলেছেন হাদিসটি হাসান এবং গরিব আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন ৬১৪ ]আবু বকর রা. বললেন: হে বৎস! তোমার ধংস হোক। তুমি আমাকে ধংসের দার প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলে। আমি ভয় পেয়েছিলাম এই হারাম মালের দ্বারা আমার গোস্তের বৃদ্ধি ঘটবে যদি এমন হয়ে যেত তাহলে আমার কি হত? আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:: " إنه لا يربو لحم نبت من سحت إلا كانت النار أولى به"3.ঘুষের মাধ্যমে যে গোস্ত তৈরী হয় তা বৃদ্ধি পায় না বরং তা আগুনের জন্য বেশি উপযুক্ত। [ তিরমিযি, ভ্রমন অধ্যায় كتاب الصلاة]    আয়েশা রা. বলেন: তোমরা সবাই উত্তম ইবাদত থেকে অমনোযগী হয়ে আছো আর তা হল : খোদাভীরু হয়ে চলা। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন: তোমরা যদি নামায পড়তে পড়তে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে যাও। আর রোযা রাখতে রাখতে তারের মত কঙ্কাল হয়ে যাও তোমাদের পক্ষ থেকে তা অতক্ষণ পর্যন্ত কবুল হবে না যতক্ষণ না তোমরা খোদাভীরু হয়ে তা পালন  না করবা।উমর ফারুক রা. বলেন: আমরা হালাল উশরের এক নবম অংশ এই ভয়ে নিতাম না যদি আমরা হারামের মধ্যে পড়ে যাই। পূর্বসুরীদের অবস্থা তো এমন পর্যায়ে পৌছেঁছিল কোন ওয়ায়েজ মানুষের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করতে চাইলে তার মধ্যে তিনটি বিষয় খুজেঁ দেখতে বলতেন: যদি সে বিদআতের আকিদা পোষণ করে তবে সে শয়তানের ভাষায় কথা বলবে তার ওয়াজে বসবে না। আর যদি হারাম ভক্ষণ করে তবে সে প্রবৃত্তি অনুযায়ি কথা বলবে। আর যদি তার বুদ্ধি কম থাকে তবে সংশোধন করার চেয়ে অধিক পরিমাণে পথভ্রষ্ট করবে তার কাছে বসবে না।ইয়াহইয়া ইবনে মুআজ রা. বলেন: আনুগত্য আল্লাহর ভান্ডারের মধ্য থেকে একটি ভান্ডার তার চাবি হল দুআ। কিন্তু হালাল খাদ্য তা নষ্ট হয়ে যাওয়া রোধ করে।সবচেয়ে বিপদ জনক বিষয় হল মানুষ দুনিয়ার দিকে ঝাপিয়ে পড়েছে আর দুনিয়া উপার্জন করছে যে কোন পন্থায় হালাল হারাম বাঁচ বিচার করছে না। তাদের চিন্তা একটাই সম্পদ কিভাবে হাতে আসবে এটা দেখছে না তা হারাম না হালাল? কিভাবে ধনী হতে পারবে সেটাই চিন্তা করে সারা জীবন। এ কারনে অনেকে হিদায়েতের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।আল্লাহ তাআলা বলেন: أَفَمَن يَمْشِي مُكِبًّا عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمَّن يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ سورة الملك: 22.যে ব্যক্তি উপুড় হয়ে মুখের উপর ভর দিয়ে চলে সে কি অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত নাকি সেই ব্যক্তি, যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে? [ সূরা আল মুলক ২২ আয়াত ]রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:" إن الله قسم بينكم أخلاقكم كما قسم بينكم أرزاقكم، وإن الله يعطي الدنيا من يحب ومن لا يحب، ولا يعطي الدين إلا من يحب، فمن أعطاه الله الدين فقد أحبه. والذي نفسي بيده لا يُسلم عبد حتى يسلم قلبه ولسانه، ولا يؤمن حتى يأمَن جاره بوائقه " قالوا: وما بوائقه يا نبي الله؟ قال: " غشمه وظلمه، ولا يكسب عبد مالاً من حرام فينفق منه فيبارك له فيه، ولا يتصدّق به فيقبل منه، ولا يتركه خلف ظهره إلا كان زاده إلى النار، إن الله لا يمحو السيئ بالسيئ، ولكن يمحو السيئ بالحسن، إن الخبيث لا يمحو الخبيث " أخرجه الإمام أحمد في المسند وإسناده ضعيف.অল্লাহ তাআলা তোমাদের মধ্যে তোমাদের চরিত্রকে বন্টন করেছেন যেমন তোমাদের রিযক তোমাদের মধ্যে বন্টন করেছেন। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সম্পদ দান করেন যাকে ভালবাসেন এবং যাকে ভাল না বাসেন তাকেও। আর দ্বীন দান করেন যাকে তিনি ভালবাসেন শুধু তাকে। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার অন্তর এবং জিহবা মুসলমান হবে। আর ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার প্রতিবেশি তার বাওয়ায়েক থেকে নিরাপদে থাকবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন বাওয়ায়েক কি জিনিস হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন: তার যুলুম অত্যাচার। আর এটা কখনো হবে না, যে কেহ হারাম উপার্জন করবে তার থেকে খরচ করবে আর আল্লাহ তাতে বরকত দেবেন এবং তার থেকে দান করবেন আর আল্লাহ সে দান কবুল করবেন। আর সে তার থেকে যা কিছু রেখে যাবে তা তার আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়ার বস্তু হবে। আল্লাহ তাআলা খারাপ দ্বারা খারাপের প্রতিকার করেন না। কিন্তু ভাল দ্বারা খারাপ মিটিয়ে দেন। খারা কখনও খারাপ-কে মিটাতে পারে না। [ আহমাদ হাদিসের সনদটিতে দুর্বলতা রয়েছে  ] বুখারি মুসলিমে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:" إن أكثر ما أخاف عليكم ما يخرج الله لكم من بركات الأرض " قيل: وما بركات الأرض؟ قال: " زهرة الدنيا "، ثم قال: " إن هذا المال خضرة حلوة، من أخذه بحقه ووضعه في حقه فنعم المعونة هو، وإن أخذه بغير حقه كان كالذي يأكل ولا يشبع، ويكون عليه شهيدًا يوم القيامة ".তোমাদের জন্য আমি সবচেয়ে যে বিষয়টির বেশী ভয় করি তা হল আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যে বারাকতুল আরদ বের করবেন। প্রশ্ন করা হল, বারাকাতে আরদ কি জিনিস? তিনি বললেন: দুনিয়ার চাকচিক্য। অতপর বললেন: এই মাল সম্পদ সবুজ এবং মিষ্ট। এই মালের অধিকারসহ যে গ্রহণ করবে এবং জায়গামত তা ব্যয় করবে, সে এর মাধ্যমে সে উত্তম সাহায্য পাবে। আর যদি অন্যায় ভাবে সম্পদ গ্রহণ করে, তাহলে তার দৃষ্টান্ত সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে খাদ্য গ্রহণ করে কিস্তু তৃপ্ত হয় না। আর ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন তার বিপক্ষে সাক্ষী হবে।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, যে ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে লোভ লালসা তার মনের মধ্যে অনেক বেশি বাসা বাধেঁ। সে মনে কখনও শান্তি পায় না। সব সময় কৃপণতা করে। তাদের হাত ভর্তি কিন্তু মন খালি। মানুষ তাদের সম্পর্কে বলে: ধনীরা গরিবদের সম্পদের প্রতি বেশি লোভাতুর হয়। কেননা হাদিসের ভাষা অনুযায়ী তারা হল এমন যে, খাবার গ্রহণ করে তবে তাদের পেট ভরে না। আর যে সুদের কারবারের মধ্যে পড়ে যায়, সে তার থেকে তওবা করে না। ফলে সুদ গ্রহণ করা থেকে তার মধ্যে অনুশোচনা আসে না। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, অন্যায় কাজ তার জন্য সুন্দর করে দেখানো হয়। সে নিজে সেটিকে ভাল মনে করে। ফলে কোন বাহানা বা ষড়যন্ত্র করতে ত্রুটি করে না। আমরা দেখতে পাই তাদেরকে যারা মানুষের সাথে ধোকাবাজি করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অথবা শুনতে পাই তাদের সম্পর্কে যারা কোন কাজ করে দিয়ে তার পরিবর্তে ঘুষ নেয়  অথবা জমির দালালি করে পয়সা নেয় তাদের এই হারাম উপায়ে অর্জন করতে অন্তর কাপে না। তারা মানুষের ন্যায্য অধিকার দিতে কার্পণ্য করে শ্রমিকের মজুরি ঠিকমত দেয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর রব বলে ঈমান এনেছে। মুহাম্মাদ-কে নবী বলে মেনে নিয়েছে। ইসলাম-কে দ্বীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে তার পক্ষে এমন করা কিভাবে সম্ভব? সে কি করে হারাম খেতে পারে? সে তো জানে যে এর পরিণতি কি হবে আখেরাতে? দুনিয়াতেও এর শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হারাম উপায়ে মাল সম্পদ উপার্জনে কিভাবে রাজি হতে পারে সে? সে তার দ্বীনকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিভাবে বিক্রি করে দিতে পারে? এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُاْ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالآَخِرَةِ فَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلاَ هُمْ يُنصَرُونَ سورة البقرة: 86."তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে। সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।" [ সূরা বাকারা ৮৬ ]সবশেষে এই দুআ করি যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন:اللهم اكفنا بحلالك عن حرامك، وبطاعتك عن معصيتك، و وأغننا بفضلك عمن سواك.হে আল্লাহ! হারাম থেকে বাঁচিয়ে হালাল আমাদের জন্য যথেষ্ট করে দিন। গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে আনুগত্য যথেষ্ট করে দিন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের মুখাপেক্ষীহীন করে দিন।সমাপ্ত                                                                                                                     see  more

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

hands

অনুবাদঃ ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী | সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা:

মানবাধিকার বলতে বুঝায় মহান আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত মানুষের সহজাত অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও মানবাধিকারের মানদন্ড, সমাজভেদে এর সংজ্ঞা, প্রয়োগ ও সীমারেখা নিয়ে তৈরী হচ্ছে নানা বিতর্ক। প্রাসঙ্গিকভাবেই জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকারের বিষয়টিও সে সব আলোচনা সমালোচনায় উঠে আসছে। মানবাধিকার রক্ষায় বিশ্বের শক্তিধর রাষ্টসমূহের গৃহীত পদক্ষেপ মানুষের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক নাকি অধিকার হরণের কৌশল তা নিয়েও বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক আলোচনা।

এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সপ্তম ঈসায়ী শতাব্দির শুরুতে ফিরে যাই, তাহলে দেখা পাব এক অনুপম মহামানবের, যিনি নর-নারী তথা সকল মানবের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্ববাসীর সামনে হাযির করেছিলেন মানবাধিকারের সার্বজনীন রূপরেখা। তিনি হলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তিনি হলেন জগতের সবার জন্য Role-Model ও উসওয়ায়ে হাসানাহ। Practical Teachings এর মাধ্যমে তিনি সর্বক্ষেত্রে চমৎকার সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর দেয়া ফর্মুলাই জগতকে দিতে পারে শান্তি, সফলতা ও মুক্তি। তাঁর পূর্বযুগে যত অজ্ঞতা ছিল, বর্বরতা ছিল, যত নির্যাতন ও শোষণ ছিল, সন্ত্রাস, ভয়-ভীতি ও সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণী বিদ্বেষ ছিল, সবই তাঁর মহান আদর্শের পরশ পাথরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।

সমকালীন বিশ্বে মানুষের সার্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওহীর নির্দেশনায় তাঁর প্রবর্তিত নীতি-দর্শন ও দিক-নির্দেশনার প্রয়োগ কেবল গ্রহণযোগ্য বা প্রয়োগ উপযোগীই নয়, বরং তা একান্ত আবশ্যক। এ প্রবন্ধে আমরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এ মহামানবের অবদানের প্রধানতম দিকগুলো তুলে ধরব।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির অনেক আগ থেকে তাঁর উত্তম চরিত্র ও মানবিক গুণাবলীর জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকরা যে সময়কে ‘জাহেলিয়াতের বা অন্ধকার যুগ’ বলেছেন সেই সময়ে জন্মলাভ করেও ঝগড়া-বিবাদ, নরহত্যা, সম্পদ লুন্ঠন, ব্যভিচার ইত্যাদি অকল্যাণকর, মানবতার জন্যে চরম অবমাননাকর কাণ্ডে তিনি কখনো জড়িত হন নি। অথচ তখনকার সমাজে যে কোনো যুবকের জন্যে তা ছিল স্বাভাবিক। বরং তিনি ছিলেন এতিম, অসহায়, নির্যাতিতদের একমাত্র সহায়, সান্ত্বনাদানকারী, ধন-সম্পদের আমানত রক্ষাকারী এবং অনেকের আশ্রয়দাতা। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভীত, আতঙ্কিত মানুষ তাঁর কাছে হাজির হয়ে তাদের মূল্যবান সম্পদ আমানত রেখে যেত, আর তিনি সেই আমানতের যথাযত হেফাযত করতেন এবং যথারীতি তা ফেরত দিতেন। এভাবে নবুওয়ত লাভের অনেক আগেই আরববাসী তাকে ‘আল-আমীন’ বা ‘পরম বিশ্বস্ত’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। নবুওয়াতের পাঁচ বছর আগে পবিত্র কাবা শরীফ মেরামতকালে সেখানকার কালো পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্বস্থানে তুলে নেয়ার ব্যাপারে কলহ-দ্বন্দের সূত্রপাত হয় এবং প্রত্যেক গোত্রই এই কাজ করে মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতায় যুদ্ধোন্মুখ হয়ে পড়ে, তখন সেই গুরুতর সমস্যার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এমন একটি সমাধান দেন; যাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মর্যাদাই রক্ষিত হয়েছিল। সকলেই সন্তুষ্টচিত্তে সে ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল, আর তা ছিল একটি চাদরের মাঝখানে পাথরটি রেখে গোত্রপতিদের দিয়ে চাদরটি ধরে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া ও সবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ হাতে সেটিকে প্রতিস্থাপন করা।

সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার এই উদাহরণ তাঁর জীবনের শুরু থেকেই আজীবন নানাভাবে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তিনি গোটা আরব জাহানের নেতা হয়ে উঠলেন তখন তিনি কি সমাজ জীবনে, কি পারিবারিক জীবনে, কি রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিক জীবনে, কি বিশ্ব নাগরিক হিসাবে, সর্বক্ষেত্রে মানুষের মূল্য-মর্যাদা ও মানবাধিকারের যে সার্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল, অভূতপূর্ব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-দর্শনের কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

মানুষের বেঁচে থাকার ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের জীবনের অধিকার ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন,

সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানানো এবং মানুষকে হত্যা করা…..।[1]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

কোনো মু‘আহাদকে (মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে) হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।[2]

বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে (যাকে মানবাধিকারের আদি সনদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষকে সম্বোধন করে বলেছেন,

নিশ্চয়ই তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের (অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে) পবিত্র, যেরূপ তোমাদের এই দিন পবিত্র তোমাদের এ মাসে তোমাদের এ শহরে।[3]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং আত্মহত্যাকারী তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে আখেরাতে আত্মহত্যার অনুরূপ পন্থায় শাস্তিভোগ করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।[4]

জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগে, বিশেষত আরবদের নবজাতক বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্মলাভের পরপরই দারিদ্রের ভয়ে হত্যা বা জীবন্ত প্রোথিত করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলামী সমাজে শিশু হত্যার এ জঘন্য প্রবণতাকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে পবিত্র কুরআনের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে[5] শিশুদের জীবনের অধিকার ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা হয়।

বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন দর্শনে সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। ইসলামে বিবাহ সমভাবে একটি অধিকার ও ধর্মীয় দায়িত্ব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আর আমি নারীদের বিবাহ করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহ্ থেকে বিমুখ হল সে আমার আদর্শভুক্ত নয়।[6]

প্রকৃতপক্ষে ইসলামে ‘বিবাহ’ কেবলমাত্র জৈবিক চাহিদা পূরণের পন্থাই নয়, বরং পারস্পরিক ভালবাসা, সমঝোতা, সমবেদনা ও নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত বিবাহ ব্যবস্থা এমন একটি সামাজিক চুক্তি যাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের সম্মত বা অসম্মত হবার সমান অধিকার স্বীকৃত। বিবাহের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনকে ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেহেতু স্বামী-স্ত্রীই হল পরিবারের মূল ভিত্তি এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের উপরই প্রাথমিকভাবে পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সুখ নির্ভর করে, তাই পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে, এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে  কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে:

তাঁরা (স্ত্রীগণ) হবে তোমাদের (স্বামীদের) ভূষণ আর তোমরা (স্বামীগণ) তাদের (স্ত্রীদের) ভূষণ।[7]

সম্পত্তির মালিকানার অধিকার

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত ইসলামী অর্থব্যবস্থা সমাজতন্ত্রবাদ বা পুঁজিবাদ কোনটিকেই পুরোপুরি সমর্থন করে না বরং তা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রীয় ধারণাকে সমর্থন করে। এখানে ব্যক্তির জন্য সম্পত্তির অপ্রকৃত মালিকানা স্বীকৃত। তবে তা এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে, ব্যক্তি এখানে সম্পদ উপর্জনের লাগামহীন স্বাধীনতা লাভ করে না। ইসলামী সমাজের সকল সম্পদের প্রকৃত মালিকানা আল্লাহর। মানুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত (trustee) হিসাবে এর অর্জন, ভোগ ও বণ্টনের অধিকার লাভ করে। আল-কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,

তাদের সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।[8]

দান, খয়রাত, সদকা, যাকাত, ফিতরা প্রভৃতির মাধ্যমে বর্ধিত সম্পদের বিলি-বন্টন করে ইসলামে একটি ভারসাম্যপূর্ণ  অর্থনৈতিক অবস্থার কথাই কেবল বলা হয় নি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে কার্যকরভাবে তা প্রতিষ্ঠাও করেছেন।

স্বাধীনভাবে চলাচল, বসবাস, রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের অধিকার প্রদান করে। একই ভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বাইরে যাওয়া ও অন্য রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারও প্রতিটি ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটি ‘বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব আল্লাহর রাজত্বস্বরূপ- যা তিনি সকল মানুষের চলাচল ও বসবাসের জন্যে অবারিত করে দিয়েছেন।

নিপীড়ন-নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের অধিকার

শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেওয়াকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন,

প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার কথা বা হাত (কাজের নিপীড়ন) থেকে মুসলিমগণ নিরাপদে থাকেন।[9]

এমনকি এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় তিনি বলেছেন,

যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার উপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিযিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষাবলম্বন করব।’’[10]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো অপরাধের জন্য অন্যকে দণ্ড দেওয়ার যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রেওয়াজও চিরতরে রহিত করে দেন। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক অভিভাষণে তিনি বলেন,

জেনে রাখ, কারো অপরাধের জন্য তারা নিজেকেই দণ্ড বহন করতে হবে। সুতরাং পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধে জন্য পিতাকে দায়ী করা যাবে না।[11]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণার মূলে ছিল কুরআনের সেই বাণী,

প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী।[12]

প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে তা শুধু তারই উপর বর্তায়, আর কেউ অন্যের বোঝা বহন করে না।[13]

অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে ন্যায়বিচার লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার উপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কুরআনে প্রায় ষাটটি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন একটি আয়াতে বলা হয়েছে,

হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে, যদিও তা তোমাদের নিজদের  কিংবা পিতা-মাতার অথবা নিকট আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।[14]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খিলাফতের শাসনামলে ইসলামে বিচার ব্যবস্থা যা শাসক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত, স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, তা ছিল মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানবতাবোধ ও মানবাধিকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত।

শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায়

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন যে,

আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।[15]

কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য সাধারণ উদাহরণ রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় এবং সর্বজনস্বীকৃত অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পরিগণিত। কেননা তিনি কেবল মুসলিমদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানব জাতির আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন,

বলুন (হে নবী), হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল।[16]

দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায়

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তি ও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন,

যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দয়া করেন না।[17]

এখানে কেবল মুসলিমদের কথাই নয় বরং গোটা মানব জাতির কথা বলা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যমীনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া করা, তাহলে উর্ধ্বালোকে যিনি আছেন তিনি তোমার প্রতি সদয় হবেন।[18]

অন্যদিকে শ্রমিক অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ খাওয়া-দাওয়া প্রদান, পোশাক-আশাক দেওয়া ও বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বারংবার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আই.এল.ও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদযাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি।

তাঁর এই গুণাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক জর্জ বার্ণাড শ’ তাই বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি,

“If all the world was united under one leader, Mohammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.”

নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়

নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। নারী মুক্তির প্রবক্তা হিসাবে আমরা হয়ত কেট মিলে (Kate Millet), জার্মেন গ্রীয়ার (Germaine Greer) বা অ্যানী নূরাকীন (Anee Nurakin) প্রমুখের নাম জানি; এক্ষেত্রে আরো উল্লেখ করা হয় মেরী উলস্টন, অ্যানী বেসামন্ত, মার্গারেট সাঙ্গাঁর, সুলতানা রাজিয়া, বেগম সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ মহিলাদের সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য যে ব্যক্তি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংসার ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ হিসাবে যে ব্যক্তি প্রথম স্বীকৃতি দেন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অধিকার পরিপূর্ণ আকারে যে ব্যক্তি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, সত্যিকার অর্থে যিনি নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির প্রবক্তা, তিনি হচ্ছেন ‘একজন পুরুষ’ এবং তিনি আর কেউ নন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একথা আদৌ অত্যুক্তি হবে না যে, জীবনে অন্য কিছু না করলেও শুধুমাত্র নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানই বিশ্ব মনীষায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুউচ্চ আসনে সুদৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত করবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম পদক্ষেপ ছিল কন্যা শিশু হত্যা বন্ধ করা। তিনি বরং কন্যা শিশুর লালন-পালনকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং নিজেও তাঁর কন্যাদের লালন-পালন কালে সেটা করে দেখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন,

(পুরুষদের জন্যে) দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে উত্তম স্ত্রী।’’[19]

অন্যদিকে নারীকে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী করেছেন। হাদীসে এসেছে,

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে কে আমার কাছে সর্বোত্তম সম্মান, মর্যাদা ও সদ্ব্যবহার পাবার যোগ্য? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার বাবা।[20]

নারী মুক্তির দিশারী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, তিনি নারীকে যথাযথ অধিকার দিয়ে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীকে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত এবং ধর্মীয় সব দিক দিয়ে তার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তসমূহকে সংক্ষেপে এভাবে উল্লেখ করা যায় :

  • ক. নারীকে পিতার সম্পত্তিতে, স্বামী, সন্তান ও মায়ের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী ধার্য করা হয়েছে।

  • খ. বিয়ের সময় নারীকে মোহরানা বা দেনমোহর প্রাপ্তি আবশ্যিক করেছেন এবং তা আদায় না করার বা তা থেকে জোর করে ব্যয় করার অধিকার স্বামী, পিতা বা ভাই কাউকে দেওয়া হয় নি।

  • গ. নারীকে স্বামী নির্বাচনের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোথাও বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একজন অকর্মন্য, অত্যাচারী স্বামী থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার নারীকে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারীকে ২য় বিবাহের বা পুনঃবিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

  • ঘ. দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি তিনি।

  • ঙ. বিদ্যাশিক্ষা করা বা জ্ঞানার্জন করার ব্যাপারে নারীকে পুরুষের মতই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম (নরনারী) এর উপর ফরয বা অবশ্য কর্তব্য’’।

  • চ. অত্যাচার, অপমান, অশালীনতা ও অবমাননা থেকে নারীকে রক্ষার জন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের পোশাক পরিধানে ও জনসমক্ষে চলাফেরার সময় একটি অনুসরণীয় পোষাক-বিধি (Dress Code) মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।

উপসংহার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জীবনদর্শন, মানবিক মর্যাদার রূপরেখা, মানবাধিকারের পরিধি ও সীমা নির্দিষ্ট করেছেন তা মহান আল্লাহ তা‘আলারই অনুমোদিত জীবন বিধান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জীবন বিধান যা মানবাধিকারের প্রথম মৌলিক এবং পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা হিসাবে স্বীকৃত তা কেবল কোনো দলীল লিখিত নয়, কোনো স্বাক্ষরিত চুক্তি নয়, কোনো অনুকল্প নয় (hypothesis) , বরং তা হচ্ছে কঠোর বাস্তবতা। নিজের শৈশব থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ৬৩ বছরের প্রত্যক্ষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত রেখে নিজের জীবদ্দশাতেই একটি ধ্বংসস্তুপ থেকে, একটি পুঁতিগন্ধময় অন্ধকার আস্তাকুড় থেকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিক মুল্যবোধকে তুলে এনে এক সুষম, অনুসরণযোগ্য, সার্বজনীন কল্যাণকর সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন – মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা ও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যই ছিল যার ভিত্তি।

মানবতার মুক্তিদূত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এই অর্জন, এই স্পষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য কল্যাণকর জীবন বিধান বিশ্বের অনেক গবেষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। মাইকেল হার্ট ‘দ্য হানড্রেড’ গ্রন্থে একশ জন ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম-বিন্যাস করেছেন। তালিকার প্রথমেই (অর্থাৎ ১ নম্বরে) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দ্বিধায় দাঁড় করিয়ে তিনি লিখেছেন:

“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both religious and secular levels.”[21]

নির্দ্বিধায় তাই বলা যায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।


[1] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮৭১।

[2] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৬৬।

[3] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৭, ১০৫, ১৭৩৯।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৫১-১২৫৩।

[5] কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানকে হত্যা করো না, তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা এ জঘন্য অপরাধ’’। সূরা আল-ইসরা/বনী ইসরাইল: ৩১।

[6] আল হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৩।

[7]  সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৭।

[8] সূরা আল-মা’আরিজ: ২৪-২৫।

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৮৪।

[10] আল-বায়হাকী, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং ৫৭৫০।

[11] আল-হাদীস, সুনান ইবনু মাজা, হাদীস নং ২৬৬৯ ও সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২১৫৯।

[12] সূরা আত-তূর: ২১।

[13] সূরা আল-আন‘আম : ১৬৪।

[14] সূরা আন-নিসা: ১৩৫।

[15] সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭।

[16] সূরা আল-‘আরাফ: ১৫৮।

[17] হাদীস নং ৭৩৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬১৭২।

[18] সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ৪৯৪৩, সুনান আত-তিরমিযি, হাদীস নং ১৯২৪।
[19] মুসলিম, ১৪৬৭।
[20] আল-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯৭১।

[21] প্রাগুক্ত, পৃ.৫৫।

Design by Md.Sahahdad Hossain | Published by ZASJSS - মুসলিম উম্মার ঐক্য |